ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ের অবাক করা সত্য | Ultimate Bangla | Trans-Siberian Railway Network


YouTube https://youtu.be/z7ROhGBoE0g

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথটিকে প্রায়ই রাশিয়ার প্রধান আন্তঃমহাদেশীয় রেলপথটির সাথে জড়িয়ে ফেলা হয় যা রাশিয়ার ইউরোপ ও এশিয়া অংশের ছোট বড় শত শত শহরকে যুক্ত করেছে। অন্যদিকে, ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথটি মস্কোর সাথে পূর্ব সাইবেরিয়ার দূর্গম অঞ্চল সমূহকে যুক্ত করেছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম রেলপথটি আটটি টাইম জোন অতিক্রম করেছে।ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের প্রধান লাইনটি মস্কো থেকে শুরু হয়ে সাইবেরিয়ার দক্ষিনাঞ্চল হয়ে ভ্লাদিভস্টক পর্যন্ত গিয়েছে। ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের প্রধান লাইন থেকে দ্বিতীয় আরেকটি রেলপথ, ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান শাখা সাইবেরিয়ার সাথে চীনের মাঞ্চুরিয়া ও বেইজিং কে যুক্ত করেছে। বৈকাল হ্রদের ১০০০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত তার্সকায়া থেকে শুরু হয়ে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে চীনের দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে প্রবেশ করেছে, যেখান থেকে একটি রূট বেইজিং কে যুক্ত করেছে। এই রুটটি চীন থেকে পুনরায় বের হয়ে ভ্লাদিভস্টকের উত্তরে আবার সাইবেরিয়ায় এসে সংযুক্ত হয়েছে। এই রেলপথটিই ভ্লাদিভস্টকের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ও পুরাতন রেলপথ। এই রেলপথটি একদিক দিয়ে চীনে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে পুনরায় রাশিয়ায় ফিরে আসা সত্বেও এই লাইনে কোনো গমন-নির্গমন যাত্রিসেবা নেই। কিন্তু তা সত্বেও এই পথে চীন ও রাশিয়ার অনেক যাত্রীরা যাতায়াত করে থাকেন।


রাশিয়ান সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯ শতকের শেষের দিকে, সাইবেরিয়া সহ রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দূরবর্তী স্থান গুলোতে দুর্বল যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছিলো। “গ্রেট সাইবেরিয়ান রুট” ছাড়া ঐ সময় চাকা যুক্ত যান চলাচলের উপযোগী কোনো রাস্তা ছিলোনা। ফলে বছরের প্রায় পাঁচ মাস নদী পথই ছিলো একমাত্র ভরসা। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় শীতকালে বরফের উপর দিয়ে ঘোড়ায় টানা স্লেজ গাড়িতে করে পণ্য আনা-নেয়া ও যাত্রীবহনের কাজ করা হতো। ফলে, ধীর গতির ও অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে রাশিয়ার এই অঞ্চল সমূহের সমস্যা কেবল দীর্ঘায়িত হচ্ছিলো। এরপর বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনার পর ১৮৯১ থেকে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের নির্মাণ কাজ পুরুদমে শুরু হয়।১৮৯১ সালে তৎকালীন জার, আলেক্সান্ডার(III)ট্রান্স সাইবেরিয়ান প্রজেক্টের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এই নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত অর্থমন্ত্রী সার্জেই উইট। রেললাইনটির নির্মাণ কার্য শুরু হয় দুই প্রান্ত থেকে, অর্থাৎ মস্কো ও ভ্লাদিভস্টক- উভয় প্রান্ত থেকে। ১৮৯১ সালের মে মাসে, জারপুত্র জারেভিচ নিকোলাই আলেক্সান্দ্রোভিচ(পরবর্তীতে জার নিকোলাস II) ভ্লাদিভস্টকে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনটি ধাপে , দশ বছরের মধ্যে রেললাইন এর নির্মাণ কাজ করার শেষ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।প্রথম ধাপে ছিলো নকশা চূড়ান্ত করণ ও পশ্চিম সাইবেরিয়ান রেলপথের নির্মাণ কার্য সম্পাদন যার দৈর্ঘ্য ছিলো, চেলিয়াবিন্সক থেকে অব নদী পর্যন্ত (১৪১৮ কি.মি.), অব থেকে আরকুস্ক পর্যন্ত সেন্ট্রাল সাইবেরিয়ান রেলওয়ে (১৮৭১কি.মি.) এবং ভ্লাদিভস্টক থেকে গ্রাফস্কায়া স্টেশন পর্যন্ত দক্ষিণ উসূরি রেলওয়ে (৪০৮কি.মি.)। এরপর যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে বাকি অংশের কাজ শেষ করা হয়।


ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের নির্মাণ ব্যয় বহন করা হয় ঋনের মাধ্যমে ও ট্যাক্স বৃদ্ধি করে। রেলপথের নির্মাণ কাজ এতো দ্রুত হচ্ছিল যে প্রায় সময়ই ঠিকভাবে এর তদারক করা সম্ভব হতো না। ফলে, স্লিপার তৈরিতে অনেক সময় অপরিপক্ক গাছ ব্যবহার করা হতো। এছাড়া বিশাল এক শ্রমিক বাহিনীকে নিয়মিত খাদ্য ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হতো। ফলে, অনেক টাকা-পয়সা লুটপাট ও হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সীমাহীন পর্বত চূঁড়া, নদী-নালা, বনভূমি আর বিস্তীর্ণ জলাশয়, কনকনে ঠান্ডা-সব ছাঁপিয়ে প্রস্তুত হয় ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ।

মস্কোর ইয়ারোস্লাভ স্টেশনটি উন্মোক্ত হয় ১৯০২ সালে এবং ১৯০৩ সালের গ্রীষ্মকালে প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। বৈকাল হ্রদ এর দক্ষিণ প্রান্তে তখনো রেল লাইনের সংযোগ সম্পন্ন না হওয়ার ফলে “বৈকাল ফেরি” নামক একটি ফেরির সাহায্যে হ্রদ পার হয়। কিন্তু ওই বছরেই ৩৩টি টানেল ও একশোর ও বেশি সংযোগ সেতুর সাহায্যে রেললাইনের কাজ শেষ করা হয়।

সিঙ্গেল ট্র্যাক থাকায় শুধুমাত্র একমুখীট্রেন চলাচলের ফলে রাশিয়ান সৈন্যদের জন্য প্রয়োজনীয় রশদ সংগ্রহে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই রেলপথ দিয়েই বিপুল পরিমান পণ্যসামগ্রী গোলাবারুদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হতো। ১৯৪১ সালের মার্চ পর্যন্ত জার্মানির জন্য গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ টন পণ্য সামগ্রী পরিবহন করা হতো। এই সময় বিপুল সংখ্যক ইহুদি ও নাৎসি বিরোধীরা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ ধরেই ইউরোপ এ পালিয়ে আসে। কিন্তু ১৯৪১ সালের ২২শে জুনের পর থেকে এই চিত্র পালটে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পর, জার্মানি রাশিয়ার এই বানিজ্য পথটিও অচল করে দেয়। তবে যাই হোক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।

 

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ ওই সময়ে শুধু মাত্র রাশিয়া নয় বরং সারা বিশ্বের মধ্যেই একটি বিস্ময়কর ও বড়মাপের প্রজেক্ট ছিলো। এমনকি ১০০ বছর পরে এসেও ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথটি ইউরোপ ও এশিয়াকে যুক্ত করার মাধ্যমে এর মুল উদ্দেশ্য সাধন করে যাচ্ছে। বর্তমানে ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথটি একটি শক্তিশালী ডাবল ট্র্যাকের বিদ্যুৎ চালিত রেলপথ যার দৈর্ঘ্য প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার।

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে ভ্রমন করা অনেকের জন্য রীতিমত স্বপ্নের ব্যাপার। এর কারণ মূলত শুধুমাত্র একটি ট্রেন ব্যবহার করে এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম রেল ভ্রমন। তিনটি ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের মধ্যে, মস্কো থেকে ভ্লাদিভস্টক পর্যন্ত ৯২৫৮ কিলমিটার পথ অতিক্রমে এর সময় লাগে ৭ দিন। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দেশটির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ ও বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের জুড়ি নেই।

 

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে ভ্রমনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ মূলত রাশিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। ছবির মত গ্রাম, দিগন্ত বিস্তৃত বরফ ছড়ানো খোলা মাঠ, ঝলমলে দেবদারুর সারি, সার বাধা বার্চ ও পাইনের বন- সব মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারনা হয়। এছাড়া ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান ও ট্রান্স মঙ্গোলিয়ান রুট যুক্ত করেছে আরো নতুন কিছু অ্যাডভেঞ্চার। ট্রান্স-মঙ্গোলিয়ান রুটে ভ্রমনের সময় চোখ জুড়াবে গোবি মরুভূমির ঢেউ খেলানো বালুময় প্রান্তর। কখনো বা তার সাথে যোগ হবে অবাধ, স্বাধীন মঙ্গোলিয়ান ঘোড়া বা উটের পাল। ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়ান রুটে দোলায়মান বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর ছাড়াও সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে চীনের মহাপ্রাচীর। সব মিলিয়ে, ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথে ভ্রমনের অভিজ্ঞতা সত্যিই অতুলনীয় হতে বাধ্য।


No comments

Theme images by chuwy. Powered by Blogger.