পৃথিবীর লুকানো মহাদেশ জিল্যান্ডিয়া | Ultimate Bangla | 8th Continent Zealandia
YouTube https://youtu.be/gSe840xhK2w
জিল্যান্ডিয়া: পৃথিবীর লুকানো মহাদেশ!
আবেল টাসমানের নিউজিল্যান্ড আবিষ্কারের একশ বছর পর ব্রিটিশ মানচিত্র-প্রস্তুতকারক জেমস কুককে পাঠানো হয়েছিল দক্ষিণ গোলার্ধে। তাঁর আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখান দিয়ে শুক্রগ্রহের অতিক্রম করাকে পর্যবেক্ষণ করা - যাতে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হিসেব করা যায়।
কিন্তু তাঁর সাথে ছিল আরেকটি বন্ধ খাম। তাকে বলে দেয়া হয়েছিল প্রথম কাজটা শেষ করার পরেই যেন তিনি তা খোলেন।
এতে ছিল অতি-গোপনীয় এক মিশনের নির্দেশিকা - সেটা হলো দক্ষিণের সেই অজানা মহাদেশ আবিষ্কার - যার ওপর দিয়েই তিনি খুব সম্ভবত নিউজিল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন।
এই জিল্যাণ্ডিয়া ছিল প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাচীন সুপার-কন্টিনেন্ট গোণ্ডওয়ানা-র অংশ। তবে সাড়ে দশ কোটি বছর আগে জিল্যাণ্ডিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। পরে এই সরু আকারের মহাদেশটি সাগরে ডুবে গিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।
কিন্তু ভূতত্ত্ববিদরা জানেন যে সরু এবং নিমজ্জিত হলেও এটি আসলে একটি মহাদেশ - যার প্রমাণ এখানে প্রাপ্ত শিলার প্রকৃতি। কারণ কন্টিনেন্টাল ভূ-স্তর প্রায় ৪০ কিলোমিটার গভীর হয়, এবং এতে গ্রানাইট, শিস্ট, এবং চুনাপাথর জাতীয় শিলা থাকে।
একটি গবেষণার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা অস্ট্রেলিয়া পূর্বপার্শ্বে ‘জিল্যান্ডিয়া’ নামের একটি নতুন মহাদেশ শণাক্ত করেছে। যদি এটি নিশ্চিত হয়, তবে ৪.৯ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার (১.৮৯ মিলিয়ন বর্গ মাইল) আয়তনের জিল্যান্ডিয়া হবে পৃথিবীর অষ্টম এবং ক্ষুদ্রতম মহাদেশ। এটি প্রশান্ত মহাসাগরে বেশিরভাগ নিমজ্জিত জমির একটি অঞ্চল এবং তার উপকূল জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্য শত শত বিলিয়ান ডলার হতে পারে।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, জিল্যান্ডিয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে এবং ৬০-৮৫ মিলিয়ন বছর আগে ডুবে যাওয়া এই মহাদেশের প্রায় ৯৪ শতাংশ রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের তলায়। নিউজিল্যান্ড এবং প্রশান্ত মহাসাগরের আরো একটি দ্বীপ রাষ্ট্র ফরাসি উপনিবেশ নিউ ক্যালেডোনিয়া, উভয়ের মাঝে এই মহাদেশটির অবস্থান। সবগুলো মহাদেশের মধ্যে এই নতুন মহাদেশটি হবে ক্ষুদ্রতম, পাতলা এবং সবচেয়ে নিমজ্জিত।
আপাতদৃশ্যে জিল্যান্ডিয়াকে বৃহৎ, সমন্বিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না, যার অর্থ এর মহাদেশ অবস্থা দাবী করতে পারে না। কিন্তু স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং সমুদ্র তলের মাধ্যাকর্ষণ মানচিত্র ব্যবহার করে সম্প্রতি জিল্যান্ডিয়ার একটি সমন্বিত এলাকা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এই ভিত্তিতে ভূতাত্ত্বিকগণ জিল্যান্ডিয়াকে মহাদেশ হিসেবে দাবি করছেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ১১ জন ভূতাত্ত্বিকের দীর্ঘ গবেষণার ফলাফল, জিল্যান্ডিয়াকে একটি মহাদেশ বিবেচনা করার জন্য প্রয়োজনীয় চারটি বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। অন্যসকল বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এর ভূখন্ডের উচ্চতা মহাসাগরীয় ভূত্বকের তুলনায় উচ্চে অবস্থিত, তাছাড়া এর বৈচিত্র্যময় ভূখন্ডে আগ্নেয়, রূপান্তরিত ও পাললিক শিলার উপস্থিতি একে মহাদেশ হিসেবে বিবেচনায় শক্ত অবস্থানে রেখেছে।
জিল্যান্ডিয়ার ভূত্বক, পার্শ্ববর্তী সমুদ্রতলের চেয়ে পুরু, কম ঘন এবং এর এলাকা পর্যাপ্ত যাতে একে মাইক্রো মহাদেশ থেকে আলাদা করেছে।
উল্লেখ্য, জিল্যান্ডিয়া শব্দটি প্রথম ১৯৯৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূপদার্থবিদ্যা অধ্যাপক ব্রুস লুয়েন্ডিক চালু করেন। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় নিযুক্ত ১১ জনই আন্তর্জাতিকভাবে এ শ্রেণির ভূত্বাত্তিক এবং তারা জিল্যান্ডিয়া এর পক্ষে সত্যিই সঠিক প্রমাণ সংগ্রহ করবেন। এটা একটি আকস্মিক আবিষ্কার না বরং এটা ছিল ক্রমান্বয়িত উপলব্ধি।’
এছাড়া ২০০৭-এ প্রকাশিত হওয়া ‘ইন সার্চ অব এন্সিয়েন্ট নিউজিল্যান্ড’ শীর্ষক বইয়ে নতুন এই মহাদেশের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছিলেন বইটির লেখক তথা গবেষণায় অংশগ্রহণকারী হামিশ ক্যাম্পবেল। তিনি জানান, ‘আগে পুরো জিল্যান্ডিয়া মহাদেশটাই জলের তলায় ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে প্লেট মুভমেন্ট-এর ফলে জলের ওপরে উঠে আসে নিউজিল্যান্ড।’
নিউজিল্যান্ডের ভূবিজ্ঞান সংস্থার করা ‘জিল্যান্ডিয়া: আর্থ’স হিডেন কন্টিনেন্ট’ নামক এই গবেষণায় জানা গেছে যে, জলের তলায় মহাদেশীয় ভূত্বক প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই দুটি দ্বীপকে জুড়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে অস্ট্রেলিয়া এবং অ্যান্টার্কটিকার থেকে একদমই আলাদা এই জিল্যান্ডিয়া মহাদেশ। এর প্লাবিত অখণ্ডতা মহাদেশীয় ভূখণ্ড সংযোগ এবং বিচ্ছিন্নকরণ সম্পর্কীয় ভূতাত্ত্বিক অন্বেষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার উদ্রেককারী। গবেষণার পুরো রিপোর্টটি প্রকাশিত হলে অনেক তথ্য জানা যাবে।
কালের আবর্তে পৃথিবী কি আরেকটি নতুন মহাদেশ পাবে নাকি শত শত বিলিয়ন ডলারের সম্পদে পরিপূর্ণ নিমজ্জিত মহাদেশটি জেগে উঠার পূর্বেই খন্ড খন্ড করে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষারত বিশ্ববাসী।
কিন্তু তবু জিল্যাণ্ডিয়ার অনেক কিছুই এখনো অজানা। এটা আকৃতিতে এত সরু কেন, কেনই বা এটা সাগরে তলিয়ে গিয়েছিল, আসলে কখনো এটা পানির ওপরে ছিল কিনা - এগুলো এখনও ভূতত্ত্ববিদদের কাছে রহস্য হয়েই রয়েছে।
আবেল টাসমান, তিনি দক্ষিণের সেই মহাদেশের সন্ধান পেয়েছিলেন কিন্তু তার ৯৪ শতাংশই যে সাগরে ডুবে আছে - তা বুঝতে পারেননি
সেটা ১৬৪২ সালের কথা। অভিজ্ঞ ডাচ নাবিক আবেল টাসমান বের হয়েছেন এক অভিযাত্রায়।
সেই সময়টা ইউরোপিয়ান নাবিক অভিযাত্রীদের সাগর পাড়ি দিয়ে নতুন নতুন ভূখন্ড আবিষ্কারের যুগ। আর পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ তখনো ইউরোপিয়ানদের কাছে এক রহস্যময় জায়গা।
প্রাচীন রোমান যুগ থেকেই ইউরোপের লোকেরা বিশ্বাস করতো, পৃথিবীর দক্ষিণদিকে কোথাও এক বিশাল ভূখণ্ড আছে, এবং তা আবিষ্কৃত হবার আগেই তার নামও দেয়া হয়ে গিয়েছিল 'টেরা অস্ট্রালিস' ।
টাসমানও নিশ্চিত ছিলেন যে দক্ষিণ গোলার্ধে এক অনাবিষ্কৃত বিশাল মহাদেশ আছে - এবং তার জেদ চেপেছিল যে সেটা খুঁজে বের করতেই হবে।
সেই ইচ্ছা নিয়েই ১৬৪২ সালের ১৪ই আগস্ট যাত্রা শুরু করলেন টাসমান। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ছিল তার কোম্পানির ঘাঁটি - সেখান থেকেই দুটি ছোট জাহাজ নিয়ে রওনা দিলেন তিনি। প্রথম গেলেন পশ্চিম দিকে, তারপর দক্ষিণে পৌঁছালেন এখন যেটা নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ড বলা হয়
উপগ্রহ চিত্রে ফুটে উঠেছে হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ: অস্ট্রেলিয়ার ডান পাশে হালকা নীল রঙের বিস্তীর্ণ অংশটিই ছিল জিল্যাণ্ডিয়া - যা সমুদ্রে ডুবে গেছে
সেখানে আরো কয়েকশ বছর আগে থেকেই বসতি স্থাপনকারী মাওরি জনগোষ্ঠীর মানুষদের সাথে টাসমানের প্রথম সাক্ষাৎ খুব প্রীতিকর হয়নি।
মাওরিরা ক্যানু জাতীয় ছোট নৌকা দিয়ে আঘাত করে ইউরোপিয়ানদের একটি ছোট নৌকা ডুবিয়ে দিল - যেটি ডাচ জাহাজগুলোর মধ্যে বার্তা বিনিময় করছিল।
এতে চার জন ইউরোপিয়ান মারা যায়। পরে ইউরোপিয়ানরা ১১টি ক্যানু লক্ষ্য করে কামানের গোলা ছোঁড়ে। তবে এতে কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা জানা যায় না।
টাসমানের অভিযান সেখানেই শেষ হয়। তিনি ওই জায়গাটার নাম দেন "মুরডেনের্স বে" যার অর্থ খুনীদের উপসাগর - এবং তারপর তাঁর নতুন পাওয়া ভূখন্ডের ওপর পা না ফেলেই তিনি কয়েক সপ্তাহ পরে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে তিনি আসলেই সেই বিরাট দক্ষিণাঞ্চলীয় মহাদেশটি আবিষ্কার করেছেন, কিন্তু একে কেন্দ্র করে যে বাণিজ্যিক লাভ হবে বলে তিনি কল্পনা করেছিলেন - তার সাথে এর কোন মিল পাননি তিনি। আর কখনো এখানে ফিরেও আসেননি টাসমান।
এখন যা অস্ট্রেলিয়া - তার কথা সে সময় অনেকেই জানতো, কিন্তু ইউরোপিয়ানরা মনে করেছিল এটি তাদের কল্পিত সেই বিশাল দক্ষিণাঞ্চলীয় মহাদেশ নয়। পরে অবশ্য তারা মত পরিবর্তন করে এবং টেরা অস্ট্রালিসের নাম থেকেই অস্ট্রেলিয়া নামটি দেয়া হয়।
কিন্তু তাসমান কখনো বুঝতে পারেননি যে তাঁর ধারণা সঠিক এবং নিখোঁজ একটি মহাদেশ সত্যিই আছে।
ছবির উৎস,
GETTY IMAGES
মাওরিদের সাথে রক্তাক্ত যুদ্ধের পর টাসমানের জাহাজ নিউজিল্যাণ্ড ছেড়ে যায়
পানির নিচের মহাদেশ 'জিল্যাণ্ডিয়া'
২০১৭ সালে সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হন এক দল ভূতত্ববিজ্ঞানী।
তারা ঘোষণা করেন যে তারা জিল্যান্ডিয়া নামে এক মহাদেশ আবিষ্কার করেছেন যার আয়তন ১৮ লক্ষ ৯০ হাজার বর্গমাইল। মাওরি ভাষায় এর নাম তে-রিউ-আ-মাওয়ি, এবং এটা মাদাগাস্কারের চেয়ে ৬ গুণ বড়।
এতদিন পর্যন্ত পৃথিবীর যত বিশ্বকোষ, মানচিত্র, সার্চ ইঞ্জিন - সবারই ছিল এক কথা যে - মহাদেশের সংখ্যা সাতটি।
কিন্তু সেই গবেষক দল আত্মবিশ্বাসের সাথেই বললেন, এটা ঠিক নয়। মহাদেশ আটটি, এবং এই নতুনটি হচ্ছে সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে সরু, এবং নবীনতম মহাদেশ।
সমস্যা হলো, এর ৯৪ শতাংশই পানির নিচে ডুবে আছে। শুধু মাত্র কিছু দ্বীপ - যেমন নিউজিল্যান্ড - পানির ওপরে মাথা বের করে রেখেছে। কিন্তু বাকিটুকু - - আমাদের সবার চোখের সামনে - এতদিন লুকিয়ে ছিল।
নিউজিল্যান্ডের ক্রাউন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জিএনএস সায়েন্সের ভূতত্ত্ববিদ অ্যাণ্ডি টালশ হচ্ছেন 'জিল্যান্ডিয়া' আবিষ্কারক দলটির একজন। তিনি বলছেন "কোন কিছু চোখের সামনে থাকলেও যে তা উদ্ঘাটন করতে এতদিন লাগতে পারে - তারই এক দৃষ্টান্ত এটি।"
কিন্তু এ তো শুরু মাত্র। চার বছর পরও এই জিল্যাণ্ডিয়া এখনো একটি ধাঁধাঁ হয়েই আছে। এই মহাদেশ এখনো লুকিয়ে আছে ২ কিলোমিটার সাগরের পানির নিচে।
কীভাবে এ মহাদেশের জন্ম হয়েছিল? এখানে বাস করতো কারা? কতদিন ধরেই বা এটি পানির নিচে ডুবে রয়েছে?
ছবির উৎস,
GETTY IMAGES
জিল্যাণ্ডিয়া ছিল এক বিরাট মহাদেশ - যা এখন সাগরের পানির নিচে
অনেক পরিশ্রমের পর আবিষ্কার
সত্যি কথা বলতে কী, জিল্যাণ্ডিয়া সম্পর্কে জানার চেষ্টা সবসময়ই ছিল কঠিন।
আবেল টাসমানের নিউজিল্যান্ড আবিষ্কারের একশ বছর পর ব্রিটিশ মানচিত্র-প্রস্তুতকারক জেমস কুককে পাঠানো হয়েছিল দক্ষিণ গোলার্ধে। তাঁর আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব ছিল পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখান দিয়ে শুক্রগ্রহের অতিক্রম করাকে পর্যবেক্ষণ করা - যাতে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব হিসেব করা যায়।
কিন্তু তাঁর সাথে ছিল আরেকটি বন্ধ খাম। তাকে বলে দেয়া হয়েছিল প্রথম কাজটা শেষ করার পরেই যেন তিনি তা খোলেন।
এতে ছিল অতি-গোপনীয় এক মিশনের নির্দেশিকা - সেটা হলো দক্ষিণের সেই অজানা মহাদেশ আবিষ্কার - যার ওপর দিয়েই তিনি খুব সম্ভবত নিউজিল্যান্ডে পৌঁছেছিলেন।
ছবির উৎস,
GETTY IMAGES
বর্তমান নিউজিল্যাণ্ড ছিল জিল্যাণ্ডিয়ার পার্বত্য এলাকার উচ্চতম অংশ
জিল্যাণ্ডিয়ার অস্তিত্বের সন্ধান প্রথম কে পেয়েছিলেন?
স্কটিশ প্রকৃতিবিদ স্যার জেমস হেক্টর ১৮৯৫ সালে নিউজিল্যাণ্ডের দক্ষিণ উপকুলবর্তী অনেক দ্বীপ জরিপ করতে এক সফরে গিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম জিল্যাণ্ডিয়ার অস্তিত্বের প্রমাণ চিহ্নিত করেছিলেন।
ওই দ্বীপগুলোর ভূতাত্ত্বিক গঠন পরীক্ষা করে তিনি বলেছিলেন, "নিউজিল্যাণ্ড হচ্ছে একটি পর্বতমালার অবশিষ্টাংশ - যা হচ্ছে বর্তমানে পানিতে-ডুবে-থাকা একটি মহাদেশীয় এলাকার চূড়া, এবং এটি দক্ষিণ ও পূর্বদিকে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।"
কিন্তু এর পরও জিল্যাণ্ডিয়ার বিষয়টি অনেকটাই অস্পষ্ট রয়ে যায়, এবং ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কিছুই ঘটেনি।
১৯৬০-এর দশকে ভূতত্ত্ববিদরা একটা মহাদেশের সংজ্ঞার ব্যাপারে একমত হন যে এটা হতে হবে এমন এক ভূতাত্ত্বিক অঞ্চল যা বিশাল এবং উঁচু, যাতে নানারকম শিলার উপস্থিতি থাকবে, যার উপরের স্তর হবে পুরু।
এর পর ১৯৯৫ সালে আমেরিকান ভূ-পদার্থবিদ ব্রুস লুইয়েনডাইক এই এলাকাটিকে আবার মহাদেশ হিসেবে বর্ণনা করে প্রস্তাব দেন - একে জিল্যাণ্ডিয়া নামে ডাকা হোক।
ছবির উৎস,
GETTY IMAGES
অস্ট্রেলিয়া ও টাসমানিয়ার উপগ্রহ চিত্র
প্রায় একই সময় জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত কনভেনশন কার্যকর হয় - যার ফলে বিভিন্ন দেশের পক্ষে তাদের উপকুল থেকে ২০০ মাইল পর্যন্ত এলাকাকে তাদের 'কন্টিনেন্টাল শেলফ'- বা মহীসোপানের অংশ হিসেবে দাবি করতে পারে- এবং সেখানকার খনিজ সম্পদও আহরণ করতে পারে।
এখন নিউজিল্যাণ্ড যদি প্রমাণ করতে পারে যে দেশটি একটি বৃহত্তর মহাদেশের অংশ - তাহলে তাদের ভূখন্ডের পরিমাণ অন্তত ৬ গুণ বেড়ে যাবে।
এই কনভেনশনের পর থেকেই সহসা ওই এলাকা নিয়ে গবেষণায় উৎসাহ তৈরি হলো। জরিপ থেকে যেসব শিলা পাওয়া গেল - তাতে জিল্যাণ্ডিয়ার অস্তিত্বের পক্ষে আরও স্পষ্ট প্রমাণ মিলতে লাগলো।
এর পর এলো উপগ্রহ প্রযুক্তি থেকে পাওয়া উপাত্ত। উপগ্রহ থেকে সমুদ্রের তলার ভূপ্রকৃতির যে বিশদ মানচিত্র তৈরি হলো তাতে স্পষ্ট ফুটে উঠলো জিল্যাণ্ডিয়ার ছবি - দেখা গেল তা আকারে প্রায় অস্ট্রেলিয়ার সমান বড়।
ছবির উৎস,
GETTY IMAGES
প্রাচীন গোণ্ডওয়ানা সুপারকন্টিনেন্টের গাছপালা এখনো অস্ট্রেলিয়ার ডোরিগো বনভূমিতে পাওয়া যায়।
২০১৭ সালের জরিপের প্রধান ভূতত্ত্ববিদ নিক মর্টিমার বলছেন, "ব্যাপারটা সত্যি অন্যরকম। পৃথিবীর অন্য সব মহাদেশেই অনেকগুলো দেশ আছে। কিন্তু জিল্যাণ্ডিয়ায় আছে মাত্র তিনটি।"
এগুলো হচ্ছে নিউজিল্যাণ্ড, ফরাসী উপনিবেশ নিউ ক্যালেডোনিয়া, আর অস্ট্রেলিয়ার ক্ষুদ্র লর্ড হাউ দ্বীপ ও বল'স পিরামিড।
রহস্যময় ভূখণ্ড
এই জিল্যাণ্ডিয়া ছিল প্রায় ৫৫ কোটি বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাচীন সুপার-কন্টিনেন্ট গোণ্ডওয়ানা-র অংশ। তবে সাড়ে দশ কোটি বছর আগে জিল্যাণ্ডিয়া বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে - যার কারণ এখনো অজানা বলছিলেন টালশ। পরে এই সরু আকারের মহাদেশটি সাগরে ডুবে গিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।
কিন্তু ভূতত্ত্ববিদরা জানেন যে সরু এবং নিমজ্জিত হলেও এটি আসলে একটি মহাদেশ - যার প্রমাণ এখানে প্রাপ্ত শিলার প্রকৃতি। কারণ কন্টিনেন্টাল ভূ-স্তর প্রায় ৪০ কিলোমিটার গভীর হয়, এবং এতে গ্রানাইট, শিস্ট, এবং চুনাপাথর জাতীয় শিলা থাকে।
কিন্তু তবু জিল্যাণ্ডিয়ার অনেক কিছুই এখনো অজানা। এটা আকৃতিতে এত সরু কেন, কেনই বা এটা সাগরে তলিয়ে গিয়েছিল, আসলে কখনো এটা পানির ওপরে ছিল কিনা - এগুলো এখনও ভূতত্ত্ববিদদের কাছে রহস্য হয়েই রয়েছে।
ছবির উৎস,
GETTY IMAGES
নিউজিল্যাণ্ডের কিউই পাখির নিকটতম আত্মীয় কেন বহুদূরের মাদাগাস্কারে - তা এক রহস্য
টালশ বলছেন, জিল্যাণ্ডিয়া কখনো শুকনো স্থলভূমি ছিল কিনা, নাকি চিরকালই কিছু দ্বীপ ছাড়া পানির নিচে ডুবে ছিল - এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে।
যদি বলা যায় যে এটা স্থলভূমি ছিল - তাহলে এখানে কি প্রাণী বাস করতো, সেটাও একটা প্রশ্ন।
মনে করা হয় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং বিরাট আয়তনের কারণে গোণ্ডওয়ানাতে প্রচুর উদ্ভিদ ও চারপেয়ে জন্তুসহ বহু প্রাণী ছিল। তার একটি ছিল অতিকায় টিটানোসর।
তাহলে কি জিল্যাণ্ডিয়ার মাটিতে এখনো তাদের দেহাবশেষ পাওয়া যাবে?
নিউজিল্যাণ্ডে ১৯৯০ এর দশকে এবং ২০০৬ সালে অতিকায় তৃণভোজী ও মাংসাশী ডাইনোসরের দেহাবশেষ বা ফসিল পাওয়া গেছে।
এগুলোর জীবনকাল গোণ্ডওয়ানা থেকে জিল্যাণ্ডিয়ার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরবর্তী সময়ের সাথে মিলে যায়। কিন্তু তা হলেও, জিল্যান্ডিয়ায় ডাইনোসর ঘুরে বেড়াতো কিনা - এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে।
No comments