South Africa's Nuclear Weapons Documentary || Why South Africa Gave up Nuke Power ? @ultimatebangla
YouTube https://youtu.be/K6USkQ0jVeM
আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করেছিল। নিজেদের প্রযুক্তিতে ছয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে সপ্তমটি তৈরির পথে ছিল। কিন্তু দেশটি আবার নিজেরাই তা ধ্বংস করে দেয়! বর্তমানের প্রেক্ষিতে খবরটি আসলেই বিস্ময়কর। কারণ, পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ দেশগুলো সামরিক ও রাজনৈতিক ঘটনার দর কষাকষিতে অনেক সুবিধা পেয়ে থাকে। তাদের নিজস্ব একটি সফট পাওয়ার থাকে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে হার্ড পাওয়ারের সাথে সফট পাওয়ারের গুরুত্ব অনেক।
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতায় তখন ন্যাশনাল পার্টির সরকার। দলটি একটি রক্ষণশীল কমিউনিস্টবিরোধী দল। তাছাড়া, এই রাজনৈতিক দল দেশটিতে শ্বেতাঙ্গদের প্রতিনিধিত্ব করছিল। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা জাতিগত বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা ও বর্ণবৈষম্যের জন্য সারা বিশ্বেই আলোচিত। বিশ্বব্যবস্থায় দুটি ব্লক তৈরি হয়ে গিয়েছিলো, যার একটির নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং অপরটির নেতৃত্বে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট ছিল। অবশ্য এর পেছনে যথেষ্ট কারণও ছিল।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই ব্লকই নিজেদের দিকে অন্যান্য দেশকে টানার চেষ্টা করে আসছিল। বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে মার্কিন সরকার এগিয়ে আসে। তারা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামও সরবরাহ করে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী নিন্দিত বর্ণবাদী সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না। একইসাথে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফ্রিকার দেশগুলোতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছিল।
‘অপারেশন কার্লোটা’ নামে সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট কিউবান বাহিনি অ্যাঙ্গোলায় মোতায়েন করা হয়। কমিউনিজমবিরোধী আফ্রিকান সরকার হয়তো চিন্তা করেছিল যে, বিপদের দিনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা আসবে না। ১৯৬৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত চুক্তি এনপিটি (NPT) বিশ্বের দেশগুলোর স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বিশ্বব্যাপী এক চাপের মুখে পড়ে দেশটি।
পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কারণ :
বর্ণবাদের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন পাচ্ছিল না দক্ষিণ আফ্রিকা। তাই দেশটি ভীত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সরাসরি সামরিক সংঘাত কিংবা যুদ্ধ শুরু নিয়ে। যদি এরকমই ঘটে তাহলে আমেরিকা তথা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে সেসময় সাহায্য হয়তো পাওয়া যাবে না। এজন্য তারা নিজেরাই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। তারা বুঝতে পারে যে নিজেদের প্রয়োজনে, নিজের দেশের মানুষ রক্ষার জন্য পারমাণবিক বোমার বিকল্প নেই। তাই তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির এক গোপন প্রকল্প হাতে শুরু করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আশংকা সত্যি হয়। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে তারা তাদের প্রকল্প এগিয়ে নিতে থাকে। তারা ভাবতে শুরু করে- নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে বিশ্বমঞ্চে তারা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
একেবারে শুরুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইউরেনিয়াম খনি ও শিল্প বাণিজ্যের দায়িত্ব দেশটির ‘পারমাণবিক শক্তি কর্পোরেশন’ এর হাতে চলে আসে। ১৯৫৭ সালে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ৫০ বছর মেয়াদী ‘অ্যাটম ফর পিস’ এর অধীনে একটি সমঝোতায় পৌঁছায়। ১৯৬৫ সালে মার্কিন সহায়তায় পারমাণবিক গবেষণা চুল্লি তৈরি করে। ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা প্লুটোনিয়াম সক্ষমতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজেদের পারমাণবিক চুল্লি ‘সাফারি-২’ প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে ৬০৬ কেজি এবং ২% ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ শেষ করে।
পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকজন সিনিয়র বিজ্ঞানী ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য জার্মানির বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় যান। সেখানে গিয়ে পাকিস্তানি এক বিজ্ঞানীর সহায়তা পান তারা। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার ১৯৭০ সালে এক জাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিষয়টা এতটাই গোপনীয় ছিল যে মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যই এই বিষয়ে জানতেন না। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় জ্বালানী ও খনি মন্ত্রী এফ ডব্লিউ ক্লার্ক খনিজ শিল্পে শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের অনুমোদন দিয়ে দেন। এভাবেই খনিতে ব্যবহারের কথা বলে দক্ষিণ আফ্রিকায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু হয়। সময়ের প্রেক্ষিতে দক্ষিণ আফ্রিকা জাপানের হিরোশিমা ধরনের ৬টি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সক্ষম হয়, এবং ৭ম বোমাটিও প্রায় অর্ধেক তৈরি হয়ে যায়। পরে বিশ্ববাসী জানতে পারে যে দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৭৯ সালেই পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশে পরিণত হয়ে গিয়েছিল!
সে সময় একটি গুঞ্জন চালু ছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ইসরায়েল এবং ফ্রান্সের যোগাযোগ আছে ৷ অনেকে মনে করেন, এক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকা এসব দেশ থেকে সহযোগিতা পেয়ে থাকতেও পারে। সত্যিকারার্থে তখনকার প্রেক্ষিতে সহযোগিতা ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি খুব কঠিনই ছিল। এই বিষয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার জ্বালানি ও খনি মন্ত্রী ডব্লিউ ডি ক্লার্ক ১৯৮৯ সালে দেশটির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভার ত্যাগের ঘোষণা দেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা কেন পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করেছিল?
যেসব উদ্দেশ্য সামনে রেখে দক্ষিণ আফ্রিকা পারমাণবিক শক্তিধর হতে চেয়েছিল, সেসব উদ্দেশ্য নিজে নিজেই হাসিল হতে চলেছিল। এক সংবাদ মাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক পারমাণবিক শক্তিধর হতে চাওয়ার মূল কারণগুলো বলেন। সেসবের মাঝে আছে আফ্রিকায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণবাদ নীতি, আফ্রিকার দেশে দেশে স্বাধীনতাকামীদের সোভিয়েত অস্ত্র সহায়তা, প্রশিক্ষণ, হাজার হাজার সৈন্য মোতায়েনের জন্য অর্থায়ন, বিশেষ করে অ্যাঙ্গোলায় কিউবান সৈন্য মোতায়েন। তাছাড়া, বর্ণ বৈষম্যের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা পুরো পৃথিবীতেই ছিল নিন্দিত। কিন্তু যদি সবগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে সমাধান হয়ে যায়, তবে আর এই মারণাস্ত্রের দরকারই বা কোথায়?
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। কিউবান সৈন্য অ্যাঙ্গোলা থেকে এক চুক্তির মাধ্যমে ফিরে গেল। বন্ধ হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণবাদ। বার্লিন প্রাচীরের পতন হলো ৷ দক্ষিণ আফ্রিকার রাজ্য নামিবিয়া স্বাধীন দেশে পরিণত হলো। কমিউনিজমের প্রভাব নিয়ে আফ্রিকাকে আর চিন্তা করতে হলো না। ক্লার্ক বলেন, “আমি অনুভব করেছি যে মূলত ছোট যুদ্ধে এই ধরনের বোমা ব্যবহার করা অর্থহীন। প্রথম থেকেই, আমি ব্যক্তিগতভাবে পারমাণবিক কর্মসূচিকে গলার দড়ি হিসেবে বিবেচনা করেছি।”
অনেকে মনে করেন, বর্ণবাদী সরকারের তৈরি করা পারমাণবিক অস্ত্র পরবর্তী অন্য কোনো সরকারের হাতে চলে যাক, এটা তারা চাননি। তাই পরবর্তী সরকার আসার পূর্বেই পারমাণবিক বোমাগুলো ধ্বংস করা হয়। উল্লেখ্য, শেষপর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পেরিয়ে তখন নেলসন ম্যান্ডেলার হাতেই ক্ষমতা চলে আসে। দক্ষিণ আফ্রিকায় তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে পুনরায় গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়। ক্লার্ক সেই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তিনি ধ্বংস করে ফেলেন নিজেদের সব পারমাণবিক অস্ত্র!
ইউক্রেন, বেলারুশ ও কাজাখাস্তানের মধ্যে পার্থক্য
দক্ষিণ আফ্রিকাই একমাত্র দেশ নয় যে তারা নিজেরাই নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগ করেছে। ইউক্রেন, বেলারুশ, কাজাখাস্তানের কাছেও পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার ছিল। ১৯৯৪ সালে বুদাপেস্ট চুক্তির পর ইউক্রেন রাশিয়ার হাতে সব পারমাণবিক অস্ত্র তুলে দেয়। বিনিময়ে ইউক্রেনের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বেলারুশ ও কাজাখাস্তানের পরিণতিও একই হয়। কিন্তু বর্তমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বেলারুশকে পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র দেয়া হবে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
তবে অন্যদের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার ঘটনার মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাই একমাত্র দেশ যারা নিজেরা পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছিল এবং রক্ষণাবেক্ষণেও সক্ষম ছিল। অপরদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলো অনেকটা বাধ্য হয়েই পারমাণবিক অস্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছিল।
No comments