রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থনৈতিক গুরুত্ব || Rooppur Nuclear Project Cost@UltimateBangla
YouTube https://youtu.be/9fsjXZW1_Vc
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হল একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যেখানে তাপের উৎস একটি পারমাণবিক চুল্লি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির মতোই, তাপ বাষ্প উৎপন্ন করতে ব্যবহৃত হয় যা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত একটি বাষ্প টারবাইন চালায়। ২৭ জুন, ১৯৫৪সালে পাওয়ার গ্রিডের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ওবিনস্ক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সোভিয়েত ইউনিয়নের ওবনিনস্কে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পর্কে আলোচনা করা হবে আজকের এই পর্বে আপনি যদি আলটিমেট বাংলা চ্যানেলে নতুন হয়ে থাকেন তবে চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে বেল আইকনটি বাজিয়ে দিন।
সবশেষ ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনাসহ বিশ্বে এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।পারমাণবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব থাকে বলেই বিশ্বব্যাপী পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ভয় এবং আতঙ্ক।তবে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঝুকি কমাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে।
১৯৬১ সালে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৬২ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার পদ্মা নদীর পার্শ্ববর্তী রূপপুরকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। একাধিক সমীক্ষার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের যথার্থতা যাচাই করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৬৮ সালের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেষ্ট হাউজ, বৈদ্যুতিক উপ-কেন্দ্র ও কিছু আবাসিক ইউনিটের নির্মাণ কাজ আংশিক সম্পন্ন করা হয়। ১৯৬৯ সালে ২০০ মেগা-ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাতিল করে দেয়।
বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুর নামক স্থানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এই উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ . এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ ধরা হয়েছে।
রাশিয়ার রসাটমের এটোমস্ট্রোয় একপোর্ট নামীয় সংস্থাকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার পর এর স্থায়িত্ব হবে ১০০ বছর। দেশের ১৮ লাখ পরিবার এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সুবিধা লাভ করবে। আড়াই হাজার দক্ষ জনবলের কর্মসংস্থান হবে।
এই প্রকল্পে ২৬ হাজারের মত লোক কাজ করছেন। বিদেশিদের মধ্যে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং কাজাখাস্তানের ছয় হাজার লোক কাজ করছেন। রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি পাঁচ হাজার। বাকিরা স্থানীয়।
বাংলাদেশ ৩৩তম দেশ; যারা নিউক্লিয়ার নিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে।
কেন্দ্রটি একটানা ভালভাবে ৫০ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। আর এটি সংস্কার করে আরো ৩০ বছর চালানো যাবে। এ ধরনের একটি কেন্দ্র স্থাপন করলে ৮০ বছর সেখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। যেখানে অন্য জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ২৫ বছর পাওয়া যায়। শুরুতে কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদী উৎপাদন পরিকল্পনায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন লাভজনক হবে।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্মিত হচ্ছে ।২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুই ইউনিটের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় হচ্ছে ১২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। মোট ব্যয়ের নব্বই শতাংশ রুশ ফেডারেশন ঋণ হিসেবে দেবে। বাকি ১০ শতাংশ বাংলাদেশ অর্থায়ন করবে। ২০২৩ সালে ১২০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। ২০২৪ সাল নাগাদ দুটি রি-অ্যাক্টর থেকে আমাদের জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ যোগ হবে।
২০২৩ সালে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের ভিভিইআর-১২০০ মডেলের জেনারেশন থ্রি-প্লাস। কুলিং টাওয়ার: ৪ টি । প্রথম রি-অ্যাক্টরটি উৎপাদনে আসবে। তার একবছর পর, ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসবে দ্বিতীয় রি-অ্যাক্টরটি। দ্বিতীয়টির উৎপাদন ক্ষমতাও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ২০২৪ সাল নাগাদ আমাদের জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ যোগ হবে। আমাদের দেশের বিদ্যুতের যে চাহিদা রয়েছে, তার অন্তত দশ ভাগ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পূরণ করতে সক্ষম হবে। হিসাব মোতাবেক, দুটি রি-অ;্যাক্টর থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ২৪০০ মেগাওয়াট। ফলে পাওয়া যাবে ২৪ লাখ কিলোওয়াট বা ইউনিট। ৫ টাকা ইউনিট হিসাবে এতে প্রতি ঘণ্টায় আয় হতে পারে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। দৈনিক আয় হতে পারে ২৮ কোটি ৮০ লাখ। বাৎসরিক আয় হতে পারে ১০ হাজার ৫১২ কোটি টাকা বা ১২৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এক বছরে খরচ হতে পারে ৩৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রতিবছর বাংলাদেশকে ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু সরকারের প্রাক্কলন অনুযায়ী প্রকল্পের রিটার্ন থেকেই কিস্তির অর্থ উঠে আসবে। ফলে ভর্তুকির দরকার হবে না।
গ্রেস পিরিয়ডের কারণে রাশিয়ার দেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মার্চ থেকে। প্রতি বছর দুটি কিস্তিতে এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ৪ শতাংশ সুদ হারে প্রতি বছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্রতি ইউনিট ৫ টাকা করে ধরা হলে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও এক বছরে নিট আয় হবে ৭৭০ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং ভর্তুকি ছাড়া ঋণ পরিশোধ করেও লাভ করার সুযোগ থাকবে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনা পরবর্তী অবস্থা প্রতিরোধের লক্ষে প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সব রকম ব্যবস্থা রেখেই স্থাপন করা হচ্ছে। কেন্দ্রের ভিভিইআর-১২০০ রি-অ্যাক্টর কোর মেল্টডাউন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে রি-অ্যাক্টর কন্টেইনমেন্টকে রক্ষা করার জন্য এই কেন্দ্রটিতে থাকছে বিদ্যুৎশক্তিবিহীন দীর্ঘকালীন কুলিং রি-অ্যাক্টর ও তাপক্ষয়কারী ব্যবস্থা। এটি প্রাথমিক হিট সিঙ্কর ওপর নির্ভরশীল হবে না। দুর্ঘটনার পর রি-অ্যাক্টরকে শীতলায়ন করতে বা তাপ ক্ষয় করার জন্য সমুদ্র, নদী, কুলিং টাওয়ারের মধ্যে আলাদাভাবে ডুবিয়ে রাখার প্রয়োজন হবে না। এটির ভেতরেই অটোমেটিকভাবে শীতলায়নের কাজ হবে।
রাশিয়ার রোসাটম গত বছরের শুরুতে আরএনপিপির নিরাপত্তা নিয়ে দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে একটি ওয়েবিনারে এসব তথ্য জানান রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় পারমানবিক শক্তি প্রকৌশল ও গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও টেকনোলজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আলেক্সি পুজাকভ বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিভিইআর-১২০০ রি-অ্যাক্টর কন্টেইনমেন্টের দ্বিস্তর বিশিষ্ট দেয়াল, বেজ প্লেটসহ স্টিলের সিল ক্লাডিং, নিচ্ছিদ্র ব্যবস্থা, আইসোলেটিং ভাল্ভ, পরিবহন, প্রধান ও জরুরি লক ব্যবহার করা হচ্ছে; যা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এমনকি বিমান হামলার মাধ্যমেও আরএনপিপি রি-অ্যাক্টরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্ভব হবে না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিভিইআর-১২০০ রি-অ;্যাক্টরের শুধুমাত্র পাওয়ার ইউনিট কাজ করবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও শুধু পাওয়ার ইউনিট বন্ধ হবে। এতে রেডিয়েশন বিকিরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিক বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন ।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের পাল্লায় অনেক অর্জন যোগ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন- আমদানি নির্ভর জ্বালানি থেকে তৈরি বিদ্যুতের নিশ্চয়তা পেতে যাচ্ছে দেশ। এ প্রকল্পকে ঘিরে প্রচুর পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে দেশে, যারা দেশের সম্পদে পরিণত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ডিপার্টমেন্ট চালু হয়েছে, যা উন্নত অনেক দেশের সাথে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মান বাড়াচ্ছে। তৈরি হচ্ছে সহজ ক্রেডিট ট্রান্সফারের সুবিধা। উৎপন্ন বিদ্যুৎ জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরো সচল ও মজবুত করবে। পরিবেশ দূষণের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে। এমন অনেক বিষয়ই এই প্রকল্প থেকে দেশের ভাবমূর্তিতে যোগ হবে।
No comments